পাকা চুল-দাড়ি উঠানো নিয়ে প্রিয়নবী (সা:) যা বলেছেন – ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও সঠিক আমল
পাকা চুল-দাড়ি উঠানো নিয়ে প্রিয়নবী (সা:) যা বলেছেন - ইসলামী দৃষ্টিকোণ, জেনে নিন
ইসলাম মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে, আর ব্যক্তিগত পরিচর্যার বিষয়ও এর বাইরে নয়। পাকা চুল বা দাড়ি নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) যে হাদিসসমূহে নির্দেশনা দিয়েছেন-তা আমাদের শেখায় কিভাবে স্বাভাবিক বয়স পরিবর্তনকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করতে হয়। পাকা চুল তোলা, রাখা কিংবা রং করার ব্যাপারে ইসলামী শিক্ষা একটি পরিমিত ও সুন্দর পথ দেখায়, যাতে মুসলমান তার প্রাকৃতিক রূপ বজায় রেখে sunnah অনুযায়ী চলতে পারে।
চলুন এই আর্টিকেলে আমরা জেনে নিই, পাকা চুল-দাড়ি উঠানো নিয়ে প্রিয়নবী (সা:) যা বলেছেন – ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও সঠিক আমল সম্পর্কে বিস্তারিত।ভূমিকাঃ
আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই চুল ও দাড়িতে সাদা বা পাকা রং দেখা দেয়। কারো ক্ষেত্রে কম বয়সেই পাকা চুল দেখা দেয়, আবার কারো ক্ষেত্রে এটি বয়সের শেষ দিকে গিয়ে শুরু হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো-পাকা চুল বা দাড়ি তুলে ফেলা কি ইসলাম অনুযায়ী জায়েজ? এ বিষয়ে প্রিয়নবী (সা:) কোন নির্দেশনা দিয়েছেন? হাদিসে কী বলা হয়েছে?
পাকা চুল বা দাড়ি নিয়ে অনেকেরই মনে নানা ভুল ধারণা ও অযথা ভয় কাজ করে। কেউ লুকাতে চান, কেউ আবার বুঝতে পারেন না-ইসলাম আসলে এই বিষয়ে কী বলে। তাই প্রয়োজন একটি পরিষ্কার ব্যাখ্যা, যেখানে হাদিসের নির্দেশনা, আলেমদের মতামত, চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্য-সবকিছু সহজ ভাষায় তুলে ধরা থাকবে।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা চেষ্টা করেছি ঠিক সেইটিই করতে। এখানে জানতে পারবেন-পাকা চুল-দাড়ি সম্পর্কে প্রিয়নবী (সা:) এর বয়ান, কোন ভুল ধারণা দূর করা প্রয়োজন, এবং একজন মুসলিমের করণীয় কী হওয়া উচিত। পুরো বিষয়টি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন এবং বাস্তবে অনুসরণ করতে পারেন।
পাকা চুল বা দাড়ি কেন ওঠে?
শুরুতে জেনে রাখা ভালো-ইসলামে পাকা চুল কোনো ত্রুটি নয়, বরং এটি মানুষ বৃদ্ধ হওয়ার একটি স্বাভাবিক লক্ষণ। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, মানুষের জীবনের পর্যায়গুলো আলাদা আলাদা করা হয়েছে। তবে ইসলামে পাকা চুলকে শুধু একটি জৈবিক পরিবর্তন হিসেবে দেখা হয়নি; বরং এটি এক ধরনের বরকত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়েছে।
বিজ্ঞান অনুযায়ী মানুষের চুল বা দাড়ি পাকা মূলত মেলানিন নামক এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ কমে যাওয়ার কারণে ঘটে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীর স্বাভাবিকভাবেই কম মেলানিন তৈরি করে, ফলে চুলের রঙ ধীরে ধীরে সাদা বা ধূসর হয়ে যায়। তবে শুধু বয়সই নয়-অতিরিক্ত মানসিক চাপ, জিনগত বৈশিষ্ট্য, হরমোনের অসামঞ্জস্য, আবার কখনও পুষ্টিহীনতাও দ্রুত পাকা চুলের পেছনে ভূমিকা রাখে। অনেক সময় ভিটামিন বি-১২, আয়রন বা জিঙ্কের ঘাটতি থাকলে চুলের রং আগেই হারিয়ে ফেলে। আর ধূমপান, অনিয়মিত ঘুম ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনও এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। তাই পাকা চুল বা দাড়িকে শুধু বয়সের দায় বলা ঠিক নয়-এটি শরীরের ভেতরের নানা পরিবর্তনের একটি সমন্বিত প্রতিফলন।
পাকা চুল-দাড়ি উঠানো নিয়ে হাদিস কী বলে?
এ বিষয়ে সহীহ সূত্রে বেশ কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। সবচেয়ে আলোচিত বর্ণনাটি হলো-
হাদিসঃ পাকা চুল উপড়িয়ে ফেলা নিষেধ
রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন-
“পাকা চুল উপড়ে ফেলো না, কারণ এটি মুসলিমের জন্য নূর (আলো)।”
- (সুনান আবু দাউদ)
অন্য বর্ণনায় এসেছে-
“কিয়ামতের দিন এই পাকা চুলগুলো (অর্থাৎ বার্ধক্যে ধৈর্য ধারণের নিদর্শন) আলো হিসেবে প্রদর্শিত হবে।”
হাদিস থেকে ৩টি মূল শিক্ষা পাওয়া যায়-
১। পাকা চুল ফেলে দেওয়া বা উপড়ে ফেলা নিষেধ
কারণ এটি মহান আল্লাহর দেওয়া একটি স্বাভাবিক পরিবর্তন এবং এর মধ্যে পুরস্কারের বার্তা আছে।
২। ইসলাম বয়সকে সম্মান দেয়
বার্ধক্যকে ইসলাম অপমানজনক কোনো বিষয় মনে করে না। বরং এটি অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও পরিপক্বতার প্রতীক।
৩। পাকা চুল রাখা সুন্নাহতুল ফিতরা অনুযায়ীও উত্তম
কারণ প্রাকৃতিক রূপে থাকতে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন।
তাহলে কি রং করা যাবে?
হাদিসে পাকা চুল উপড়ে ফেলা নিষেধ-কিন্তু রং করতে নিষেধ নেই, বরং অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
- হাদিসঃ চুল রং করা সুন্নাহ
রাসুল (সা:) সাহাবিদেরকে বলেছেন-
"ইহুদিদের মতো রেখো না; তোমরা তোমাদের পাকা চুল রং করো।"
- (সহিহ মুসলিম)
তবে রং করার সময় ৩টি শর্ত মানতে হবে-
১। কালো রং ব্যবহার করা নিষেধ
কারণ কালো রং দিয়ে বয়স আড়াল করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২। প্রাকৃতিক উপাদানের রং ব্যবহার উত্তম
যেমন-
-
মেহেদি
-
কাতম
-
হারবাল ডাই
৩। দাড়ির রং অতি চটকদার হওয়া উচিত নয়
তাই দেখা যাচ্ছে - রং করা যাবে, কিন্তু তুলে ফেলা যাবে না।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কেন পাকা চুল রাখা উত্তম?
১। পাকা চুল আল্লাহর নেয়ামত
যে বয়স পর্যন্ত মানুষ টিকে থাকে সেটাই তো আল্লাহর রহমত।
২। বার্ধক্যকে সম্মান করা
ইসলাম বয়স, অভিজ্ঞতা ও পরিপক্বতাকে সম্মান করে।
৩। কিয়ামতের দিন পাকা চুল পুরস্কার হিসেবে গণ্য হবে
যে মুসলিম আল্লাহর পথে চলতে চলতে বৃদ্ধ হয়েছে, তার চুলগুলো এক ধরনের নূর হিসেবে প্রকাশ পাবে।
৪। অহংকার বা বয়স আড়াল ত্যাগ করা
ইসলাম মানুষকে স্বাভাবিক থাকতে উৎসাহ দেয়।
পাকা চুল বা দাড়ি উপড়ে ফেললে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে?
এটি শুধু ইসলামেই নিষেধ নয়, মেডিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকেও ক্ষতিকর-
১। Hair follicle ক্ষতিগ্রস্ত হয়
চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে যায়।
২। একই স্থানে মোটা কালো চুল গজাতে পারে
যা দেখতে আরও খারাপ লাগতে পারে।
৩। স্কিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে
বিশেষ করে দাড়ির জায়গায়।
৪। বারবার তোলার ফলে চুল পাতলা হয়ে যেতে পারে
তাই দাড়ি/চুল তোলা শরীরের জন্যও ক্ষতিকর।
পাকা চুল-দাড়ি নিয়ে কিছু সাধারণ ভুল ধারণা
ভুল ধারণা ১। পাকা চুল তুললে আরও বেশি পাকে
এটি সত্য নয়। পাকা চুল তুললে শুধু সেই জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভুল ধারণা ২। পাকা চুল মানেই মানুষ অসুস্থ
এটি ভুল। জিনগত কারণেও হতে পারে।
ভুল ধারণা ৩। ভিটামিন খেলেই পাকা চুল কালো হয়ে যাবে
চুল যে একবার সাদা হয়, সেটি আর কালো হয় না; তবে নতুন চুল যাতে দ্রুত না পাকে-তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
পাকা চুল নিয়ে সুন্দরভাবে চলার কিছু উপায়
- স্বাস্থ্যসম্মত খাবার
ভিটামিন বি১২, আয়রন, জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার খান।
- মানসিক চাপ কমান
স্ট্রেস চুল পাকার অন্যতম কারণ।
- হারবাল রং ব্যবহার
মেহেদি ও কাতম ইসলামে অনুমোদিত এবং স্বাস্থ্যকর।
- রাসায়নিক রং এড়িয়ে চলা
এগুলো দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করতে পারে।
প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর
১। পাকা চুল বা দাড়ি তুলে ফেলা কি হারাম?
হাদিসে স্পষ্ট নিষেধ এসেছে। তাই এটি মাকরুহ তাহরিমি পর্যায়ের নিষেধ। দাড়ি বা চুল উপড়ে ফেলা উচিত নয়।
২। পাকা চুল রং করতে পারি?
হ্যাঁ, রং করা যায়। তবে কালো রং দিয়ে বয়স লুকানো নিষেধ।
৩। মেহেদি বা হারবাল হেয়ার কালার কি সুন্নাহ সম্মত?
হ্যাঁ। মেহেদি ও কাতম দিয়ে রং করা রাসুল (সা:) এর আমল থেকে প্রমাণিত।
৪। কম বয়সে পাকা চুল হলে কি সমস্যা?
না, এটি অনেক সময় জিনগত বা হরমোনের কারণে হয়। ইসলামে এটি নিয়ে কোনো সংকোচ নেই।
৫। দাড়ির পাকা চুল গোঁফের মতো ট্রিম করলে কি সমস্যা?
ট্রিম করা যাবে, কিন্তু উপড়ে ফেলা যাবে না।
উপসংহার
পাকা চুল-দাড়ি মানুষের জীবনের একটি স্বাভাবিক এবং বরকতময় লক্ষণ। প্রিয়নবী (সা:) স্পষ্ট করে বলেছেন-পাকা চুল উপড়ে ফেলো না, কারণ এটি মুসলিমের জন্য এক ধরনের নূর।
তাই ইসলাম আমাদের শেখায়-
নিজেকে লুকাতে নয়, বরং আল্লাহর দেওয়া স্বভাবিক পরিবর্তনকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করতে।
অবশ্যই প্রয়োজন হলে রং করা যাবে, তবে কালো রং ছাড়া।
মানুষ তখনই সুন্দর যখন সে তার স্বাভাবিক রূপে থাকে, আর বার্ধক্যের চিহ্নগুলো আল্লাহর নেয়ামত হিসেবে গ্রহণ করে।
[আপনি চাইলে এই আর্টিকেলটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে অন্যদের সচেতন করতে পারেন]
কীভাবে এই আর্টিকেলটি আরও উন্নত করা যায় সে সম্পর্কে আপনার কোনো পরামর্শ থাকলে দয়া করে জানাবেন।
আপনি যদি আরও এই ধরনের গাইড, টিপস বা টিউটোরিয়াল পড়তে চান, তাহলে নিয়মিত চোখ রাখুন আমাদের সাইটে https://www.baneswarit.com/ এবং আমাদের ফেসবুক পেজ ভিজিট করুনঃ https://www.facebook.com/profile.php?id=61577238192159
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url