অনলাইন গেম আসক্তি ! সমস্যা, লক্ষণ ও করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
অনলাইন গেম আসক্তি ! সমস্যা, লক্ষণ ও করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
ভূমিকাঃ
বর্তমান যুগে অনলাইন গেমস শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি অনেকের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে গেমিংয়ের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে অনিয়ন্ত্রিত ও অতিরিক্ত গেম খেলা আসক্তিতে পরিণত হতে পারে, যা ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং মানসিক জীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলে। এই সমস্যা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন একে বলা হয় “অনলাইন গেম আসক্তি” বা Internet Gaming Disorder (IGD)। এই নিবন্ধে অনলাইন গেম আসক্তির কারণ, ভয়ঙ্কর পরিণতি এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হবে।
আরো পড়ুনঃ Limewrite বাংলাদেশে আয়ের নতুন প্ল্যাটফর্ম? কীভাবে কাজ করবেন ও টাকা তুলবেন–গাইড
অনলাইন গেম আসক্তি কি?
অনলাইন গেম আসক্তি হল এক ধরনের মানসিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি নিয়মিত ও অতিরিক্তভাবে গেম খেলে এবং অন্য সকল দায়িত্ব ও কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। এটি একধরনের প্রযুক্তিগত নির্ভরতা যা ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন দিককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
অনলাইন গেম আসক্তির কারণগুলোঃ
অনলাইন গেম আসক্তির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। যেমন ঃ
১। উদ্দীপক ও আকর্ষণীয় গেমপ্লে - অনেক গেম এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে এটি ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করে রাখে।
২। সামাজিক সংযোগ - গেমের মাধ্যমে অনেকেই ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব তৈরি করে, যা তাদের আসক্ত করে তোলে।
৩। বাস্তব জীবন থেকে পালানো - অনেক তরুণ তাদের বাস্তব জীবনের চাপ থেকে মুক্তি পেতে গেমের জগতে ডুবে যায়।
৪। পুরস্কার এবং চ্যালেঞ্জ - অনলাইন গেমে বিভিন্ন ধাপ বা মিশন পেরোনোর মাধ্যমে অর্জিত পুরস্কার মানুষকে আরও বেশি খেলতে অনুপ্রাণিত করে।
৫। পরিবারের নজরদারির অভাব - অনেক সময় অভিভাবকের অসচেতনতা ও শিথিল নিয়ন্ত্রণের কারণে শিশুরা সহজেই গেম আসক্তিতে পড়ে।
৬। ডোপামিন মুক্তি - গেম জেতার পর ব্রেইনে ডোপামিন নামক ‘প্লেজার’ হরমোন নিঃসৃত হয়, যা নেশার মতো আচরণ তৈরি করে।
সূত্রঃ Harvard Health Publishing, 2020
৭। বন্ধুদের প্রভাব - সমবয়সীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বা সামাজিক চাপে পড়ে গেম খেলতে শুরু করা।
গেম আসক্তির লক্ষণসমূহ
- ঘুমের সমস্যা ও রুটিন ভেঙে যাওয়া
- পরিবার বা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া
- চোখ ও ঘাড়ে ব্যথা, দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হওয়া
- বিরক্তি বা রাগ বেড়ে যাওয়া
- গেম খেলা না পেলে মানসিক অস্থিরতা
- অর্থ ব্যয় করে গেমিং এক্সট্রা আইটেম কেনা
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ২০১৮ সালে WHO “Gaming Disorder” কে একটি রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
অনলাইন গেম আসক্তির ভয়ঙ্কর পরিণতিঃ
১। শারীরিক সমস্যাঃ
- দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের সামনে বসে থাকার ফলে চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও মেরুদণ্ডের ব্যথা দেখা দিতে পারে।
- অনিয়মিত ঘুম ও খাওয়ার কারণে পুষ্টিহীনতা ও স্থূলতার সমস্যা তৈরি হয়।
- অতিরিক্ত গেমিং হাতের পেশি ও স্নায়ুর সমস্যার কারণ হতে পারে।
২। মানসিক সমস্যাঃ
- অবসাদ ও দুশ্চিন্তাঃ বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে।
- রাগ ও আগ্রাসী মনোভাবঃ গেমের চরিত্র অনুসরণ করে অনেকেই বাস্তব জীবনেও সহিংস আচরণ করে।
- অধৈর্য ও বিরক্তিঃ গেম ছাড়ার পর ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সমস্যায় পড়ে এবং অল্পতেই রেগে যায়।
৩। সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ধ্বংসঃ
- পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়।
- ব্যক্তি একাকীত্বের শিকার হয় এবং আত্মবিশ্বাস হারায়।
- পড়াশোনা ও চাকরির প্রতি আগ্রহ কমে যায়, যা ভবিষ্যতে ব্যর্থতার কারণ হতে পারে।
৪। আর্থিক ক্ষতিঃ
- অনেক অনলাইন গেমে ইন-অ্যাপ পারচেজের মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
- কিছু গেমিং প্ল্যাটফর্মের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই বড় অঙ্কের অর্থ হারায়।
৫। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়াঃ
- অনেক গেমিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সাইবার অপরাধ, হ্যাকিং, এবং জুয়া খেলার আসক্তি তৈরি হয়।
- অনলাইন প্রতারণার মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
আরো পড়ুনঃ চোখের ইশারায় চলবে স্মার্টফোন! প্রযুক্তিতে নতুন যুগের হাতছানি।
গবেষণাভিত্তিক তথ্যঃ
-
NCBI-র মতে, বিশ্বজুড়ে কিশোরদের ৫–১০% অনলাইন গেম আসক্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
-
Cleveland Clinic-এর গবেষণা অনুযায়ী, গেম আসক্তির কারণে anxiety, depression, sleep deprivation, academic decline হতে পারে।
-
CBT (Cognitive Behavioral Therapy) অনলাইন গেম আসক্তি নিরসনের সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত।
অনলাইন গেম আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়সমূহঃ
১। সময় নির্ধারণ ও কন্ট্রোল করাঃ
গেম খেলার জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা উচিত এবং তার বাইরে গেম না খেলার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। ফোনে “Screen Time” বা “Digital Wellbeing” ব্যবহার করুন।
২। বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থাঃ
খেলাধুলা, বই পড়া, সৃজনশীল কাজ (যেমন চিত্রাঙ্কন, সংগীত চর্চা) এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো গেমের বিকল্প হতে পারে।
৩। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারঃ
স্মার্টফোন ও কম্পিউটারে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল বা স্ক্রিন টাইম লিমিট ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪। পারিবারিক নজরদারি ও সচেতনতাঃ
অভিভাবকদের উচিত শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার মনিটর করা এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। অভিভাবক হিসেবে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন, তাদের ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন এবং বিকল্প সময় কাটানোর সুযোগ দিন।
৫। পেশাদার সাহায্য নেওয়াঃ
যদি গেম আসক্তি গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়, তবে মনোবিজ্ঞানী বা পরামর্শকের সাহায্য নেওয়া উচিত। CBT ও ফ্যামিলি কাউন্সেলিং খুবই কার্যকর। বাংলাদেশের অনেক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান এই সেবা দেয়। যেমনঃ
-
Moner Bondhu
-
LifeSpring
-
Psychology Health Center (BSMMU)
আরো পড়ুনঃ সন্তানের সফলতার গোপন রহস্য ! পারিবারিক নিয়ম ও মূল্যবোধের গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
উপসংহারঃ
অনলাইন গেমিং একদিকে যেমন বিনোদনের মাধ্যম, অন্যদিকে এটি অতিরিক্ত হলে ভয়ঙ্কর পরিণতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আমাদের উচিত ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং গেমিংয়ের প্রতি সংযত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা। সচেতনতা এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই পারে আমাদের অনলাইন গেম আসক্তি থেকে রক্ষা করতে। পরিবারের সদস্য ও অভিভাবকদের উচিত সময়মতো বিষয়টি বুঝে পদক্ষেপ নেওয়া।
এই বিষয়টি সম্পর্কে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে জানাতে পারেন!
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url