নবীজি (সা.)-এর অন্তিম সময় ! একটি হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবন ছিল ত্যাগ, ধৈর্য ও মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর নবুওয়াতি জীবন ছিল ২৩ বছরব্যাপী, যেখানে তিনি মানুষকে তাওহিদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু মানবধর্ম অনুযায়ী, তাঁকেও দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। নবীজি (সা.)-এর অন্তিম সময় ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক, কিন্তু সেই মুহূর্তগুলোও আমাদের জন্য অসংখ্য শিক্ষা রেখে গেছে।
মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ ও অসুস্থতাঃ
হিজরির ১১তম বর্ষ, সফর মাসের শেষের দিকে নবীজি (সা.) কিছুটা অসুস্থতা অনুভব করেন। ধীরে ধীরে তাঁর শারীরিক দুর্বলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে, খায়বারের যুদ্ধের সময় এক ইহুদী নারীর দেওয়া বিষক্রিয়া দীর্ঘ সময় পরে তাঁর শরীরে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
নবীজি (সা.) প্রথমে উম্মুল মু’মিনীন মায়মুনা (রা.)-এর ঘরে ছিলেন, কিন্তু অসুস্থতা বেড়ে গেলে তিনি স্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রা.)-এর ঘরে স্থানান্তরিত হন। আয়েশা (রা.)-এর কোলে শায়িত থেকেই তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
শেষ দিনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাঃ
১। মসজিদে নববীতে শেষ খুতবা ও নামাজঃ
অসুস্থতার সময় নবীজি (সা.) একদিন তাঁর সাহাবাদের বললেন,
"একজন আল্লাহর বান্দাকে পৃথিবী ও আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল। সে আল্লাহকেই বেছে নিয়েছে।"
এই কথা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) কান্নায় ভেঙে পড়েন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, নবীজি (সা.) বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অসুস্থ থাকা অবস্থায় তিনি সাহাবাদের মাঝে বের হয়ে মসজিদে আসেন এবং ইমামতি করেন। এক পর্যায়ে তিনি ইমামতির দায়িত্ব হযরত আবু বকর (রা.)-এর ওপর অর্পণ করেন।
২। বিদায়ের পূর্বে দাস মুক্তি ও দানের আদেশঃ
নবীজি (সা.) তাঁর অন্তিম সময়েও দানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি তাঁর কাছে থাকা সব সম্পদ গরীবদের মাঝে বিতরণ করার নির্দেশ দেন এবং সকল দাস মুক্ত করে দেন।
৩। উসমান (রা.)-কে বিশেষ উপদেশঃ
নবীজি (সা.) হযরত উসমান (রা.)-কে ডেকে কিছু আমানত হস্তান্তর করেন এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন, যা খিলাফতের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে।
৪। আয়েশা (রা.)-এর কোলে শেষ মুহূর্তঃ
রবিবার, ১২ রবিউল আউয়াল, হিজরি ১১ (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ), নবীজি (সা.)-এর শেষ দিন। তিনি বারবার বলছিলেন:
"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নিশ্চয়ই মৃত্যুর কষ্ট অনেক কঠিন!"
তিনি আয়েশা (রা.)-এর কোলে মাথা রেখে বারবার বলছিলেনঃ
"হে আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিন।"
তারপর তিনি ধীরে ধীরে বললেনঃ
"বালিল রাফিকুল আ’লা" (সর্বোচ্চ সঙ্গীকে বেছে নিচ্ছি)। এবং এতেই তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
নবীজির (সা.) ইন্তেকালের পরের প্রতিক্রিয়াঃ
নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের সংবাদ মদিনায় ছড়িয়ে পড়লে শহরজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। হযরত উমর (রা.) এই সংবাদ শুনে বিশ্বাস করতে পারেননি এবং বললেন,
"যে বলবে নবীজি (সা.) ইন্তেকাল করেছেন, আমি তাকে হত্যা করব!"
কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) এসে দৃঢ় কণ্ঠে কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করেনঃ
"মুহাম্মাদ তো একজন রাসুল মাত্র। তাঁর আগেও বহু রাসুল গত হয়েছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা ধর্মত্যাগ করবে?" (সূরা আলে ইমরান: ১৪৪)
এই আয়াত শোনার পর উমর (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবারা শান্ত হন এবং সত্য মেনে নেন।
নবীজি (সা.)-এর দাফনঃ
সাহাবাদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত হয় যে নবীজি (সা.)-কে তাঁর ঘরেই দাফন করা হবে। হযরত আলী (রা.), আব্বাস (রা.), ফদল (রা.) ও আনসারগণ তাঁর গোসল ও কাফন প্রদান করেন। মঙ্গলবার, ১৩ রবিউল আউয়াল, তাঁকে তাঁর ঘরে দাফন করা হয়।
উপসংহারঃ
নবীজি (সা.)-এর অন্তিম সময় আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা বহন করে। তিনি মৃত্যুর আগেও দানের আদেশ দেন, নামাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এবং আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি নেন। তাঁর বিদায় পৃথিবীর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি হলেও তাঁর শিক্ষা, আদর্শ ও দোয়া আজও আমাদের মাঝে জীবিত।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
0 Comments