কোলকাতা টু লন্ডন ! এক সময়ের পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুটের অজানা ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নিন।
ভূমিকাঃ
আপনি কি জানেন, একসময় কোলকাতা থেকে লন্ডন পর্যন্ত সরাসরি বাস পরিষেবা চালু ছিল? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন! আজকের আধুনিক ফ্লাইট বা হাইস্পিড ট্রেনের যুগে দাঁড়িয়ে এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও, ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত চলেছে এই ঐতিহাসিক বাস রুট। পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুট হিসেবে একে বিবেচনা করা হত। আজ আমরা এই বিস্ময়কর যাত্রা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানব।
১। কোলকাতা থেকে লন্ডনের বাস রুটের সূচনাঃ
এই বাস পরিষেবাটি প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, যার নাম ছিল Albert Tours। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ইংল্যান্ডের এক বেসরকারি কোম্পানি। এই পরিষেবার মাধ্যমে এক দুঃসাহসিক ও ঐতিহাসিক যাত্রার পথ উন্মোচিত হয়েছিল, যা ভারত, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, ইউরোপ হয়ে ব্রিটেনে পৌঁছাত।
২। রুট ও দেশসমূহঃ
এই বাস রুটটি মোট ২০,৩০০ কিলোমিটার (প্রায়) দীর্ঘ ছিল এবং প্রায় ২০টি দেশের ভেতর দিয়ে যেত। নিচে দেশ ও শহরের তালিকা দেওয়া হলো:
- ভারত: কোলকাতা → বেনারস → আগ্রা → দিল্লি → অমৃতসর
- পাকিস্তান: লাহোর → রাওয়ালপিন্ডি
- আফগানিস্তান: কাবুল
- ইরান: তেহরান → তাবরিজ
- তুরস্ক: ইস্তাম্বুল
- ইউরোপ: বেলগ্রেড → জার্মানি → অস্ট্রিয়া → ফ্রান্স
- যুক্তরাজ্য: লন্ডন
এই রুটে যাত্রার সময় ছিল প্রায় ৪৫ দিন। ভ্রমণ চলাকালীন যাত্রীরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান, পাহাড়ি অঞ্চল, মরুভূমি ও আধুনিক শহরের স্বাদ পেতেন।
৩। বাসের সুবিধা ও বিলাসিতাঃ
Albert Tours-এর এই বাস সেবাকে শুধু “বাস ভ্রমণ” বলা যাবে না। এটি ছিল এক চলমান হোটেলের মত:
- বিলাসবহুল আসন
- ইন-হাউস কিচেন
- টিভি এবং গান শোনার ব্যবস্থা
- বিছানায় শোয়ার ব্যবস্থা
- গাইডসহ ট্যুর প্যাকেজ
- ভিসা ও সীমান্ত পেরোনোর সহায়তা
বাসে সর্বমোট ২০-৩০ জন যাত্রী উঠতে পারতেন। এই যাত্রা একদিকে যেমন রোমাঞ্চকর ছিল, তেমনি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতাও বটে।
৪। খরচঃ
১৯৫৭ সালে এই বাস যাত্রার খরচ ছিল প্রায় ৮৫ পাউন্ড (GBP)। বর্তমানে এর সমপরিমাণ অর্থ দাঁড়াবে প্রায় ৮০০-১০০০ GBP (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,২০,০০০ টাকা)। তুলনামূলকভাবে এটি ট্রেনে বা বিমানে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ হলেও অভিজ্ঞতার দিক থেকে অতুলনীয়।
৫। কোলকাতা টু লন্ডন বাস আবার চালু হওয়ার সম্ভাবনা?
২০২০ সালে Adventures Overland নামের একটি ভারতীয় সংস্থা “Bus to London” নামের একটি ট্যুর প্যাকেজ চালুর পরিকল্পনা করে। এতে প্রায় ১৮টি দেশ ঘুরে কোলকাতা থেকে লন্ডন যাওয়ার প্ল্যান ছিল। তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এই প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়।
তবে ভবিষ্যতে আবার এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৬। কেন বন্ধ হয়ে গেল এই বাস পরিষেবা?
এই অসাধারণ বাস পরিষেবাটি বন্ধ হয়ে যায় মূলত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে। বিশেষ করে:
- ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব
- আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু
- ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি
- সীমান্ত নিরাপত্তা হুমকি
এসব কারণে বাস পরিষেবা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
৭। এই ঐতিহাসিক যাত্রার তাৎপর্যঃ
এই বাস রুট ছিল শুধুমাত্র এক পরিবহন পদ্ধতি নয়, এটি ছিল এক সংস্কৃতি বিনিময়, ভ্রমণপ্রেমীদের মিলনমেলা ও আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বের প্রতীক। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইউরোপের রাস্তায় বাসে করে যাওয়া এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা, যা আজও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
উপসংহারঃ
প্রিয় পাঠকগণ, আপনারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন আজকের যুগে যেখানে বিমানে কোলকাতা থেকে লন্ডন পৌঁছাতে ১০ ঘণ্টার বেশি লাগে না, সেখানে একসময় মানুষ ৪৫ দিন ধরে বাসে করে পাড়ি জমাতো ইউরোপের পথে! এই ঐতিহাসিক বাস রুট এখন শুধু স্মৃতি হয়ে আছে, কিন্তু তার প্রভাব, ঐতিহ্য এবং রোমাঞ্চ এখনও ভ্রমণপ্রেমীদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। যদি কখনো এই পরিষেবা আবার ফিরে আসে, তবে নিঃসন্দেহে তা হবে এক অনন্য পর্যটন অভিজ্ঞতা।
যাই হোক যদি কোন মন্তব্য থেকে থাকে তবে কমেন্ট করে জানাবেন এবং আজকের আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তবে অবশ্যই বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ
0 Comments